লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাতে করনীয় কি?

সালাতুত তাসবীহ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ নামাজ। এ নামাজ পড়লে সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ গুনাহ থাকলেও আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দেন বলে কোন কোন কিতাবে আছে। সারা বছরের মাকরূহ ও হারাম ওয়াক্ত ছাড়া যে কোন সময় এ নামাজ পড়া যায়। শবে বরাতে আমরা সাধারণত নফল নামাজ, জিকির আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ তাহলিল ও কবর জিয়ারতসহ নানা ধরনের নফল ইবাদত করে থাকি। কেননা, বছরে যে বিশেষ ৫টি রাত (শবে মেরাজ, শবে বরাত, শবে কদর ও দুই ঈদের ২ রাত) রয়েছে এর মধ্যে শবে বরাত অন্যতম।

খলিফা উমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) বসরার শাসনকর্তাকে চিঠি পাঠিয়ে বলেছিলেন, বরাতের রাতে ইবাদত করা তোমাদের জন্য কর্তব্য। কেননা, এটা বিশেষ একটি রাত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা বান্দার পরবর্তী বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন।

আজ পবিত্র শবে বরাত। আল্লাহ তায়ালা হায়াতে বাঁচিয়ে রাখলে শবে বরাতে আমরা সালাতুত তাসবীহ আদায় করবো। এ নামাজের ফজিলত অপরিসীম। এ নামাজ সম্বন্ধে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, (একদা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আমার পিতা) আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবকে বলেন, হে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব! হে চাচাজান! আমি কি আপনাকে (উপহার) দেব না? আমি কি আপনার প্রতি অবদান রাখবো না? আমি কি আপনাকে সংবাদ দেব না? আমি কি আপনার মাধ্যমে ১০টি সৎকর্ম করাব না? যখন এগুলোর উপর আমল করবেন তখন আল্লাহ তায়ালা আপনার আগের ও পরের, নতুন ও পুরাতন, ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত, ছোট ও বড়, গোপন ও প্রকাশ্য সকল প্রকার গুনাহ মাফ করে দেবেন।

সুনানে আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও ইমাম বায়হাকী দাওয়াতুল কাবীরে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিজি আবু রাফে থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হাদীসের শেষাংশে বলা হয়, আপনি সক্ষম হলে প্রতিদিন একবার করে এ নামাজ আদায় করবেন। আর যদি তা না পারেন তাহলে সপ্তাহে একবার, তা না পারলে মাসে একবার, তা না পারলে বছরে একবার আদায় করবেন। যদি তাও না পারেন তাহলে জীবনে অন্তত একবার তা আদায় করবেন।

সালাতুত তাসবীহের নামাজ পড়ার নিয়ম নিম্নরূপ

প্রথমে নিয়ত করতে হবে। আরবীতে ‘নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা আরবাআা রাকায়াতি সালাতিত তাসবীহে মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার’ বলে হাত বাঁধতে হবে। আর বাংলাতে নিয়ত করলে হবে-‘আল্লাহর ওয়াস্তে ক্বিবলামুখী দাঁড়িয়ে ৪ রাকাআত সালাতুত তাসবীহের নামাজ পড়তেছি আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত করতে হবে। এরপর সানা পড়তে হবে। তারপর ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু­ ওয়াল্লাহু আকবার’ তাসবীহটি ১৫ বার পড়তে হবে। তারপর সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা মিলাতে হবে। সূরা শেষ করে তাসবীহটি ১০ বার, তারপর রুকু করতে হবে। তারপর রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবীহ পড়ার পর ১০ বার, তারপর রুকু থেকে সোজা হয়ে সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ পড়ার পর ১০ বার, এরপর সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পড়তে হবে। সিজদার তাসবীহ পড়ার পর ১০ বার, সিজদা থেকে সোজা হয়ে বসে আল্লাহুম্মাগফিরলি ওয়ারহামনি ওয়ার যুখনি ওয়াহদীনি পড়ার পর ১০ বার, তারপর পুনরায় সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পড়ে ওই তাসবীহটি ১০ বার পড়তে হবে। এতে এক রাকাআত সম্পন্ন হলো এবং তাসবীহটি ৭৫ বার পড়া হলো।

তারপর আল্লাহু আকবার বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় রাকাআতের সূরা পড়ার আগে ১৫ বার ও পরে ১০ বার, তারপর রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবীহ পড়ার পর ১০ বার, রুকু থেকে সোজা হয়ে ১০ বার, পরে সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পড়ার পর ১০ বার, দুই সিজদার মাঝখানে বসে ১০ বার, পুনরায় সিজদায় গিয়ে ১০ বার, এরপর সিজদা থেকে সোজা হয়ে বসে আত্তাহিয়াতু পড়ার পর ১০ বার তাসবীহটি পড়তে হবে। এই একই নিয়মে পরের দুই রাকাআত পড়তে হবে। এতে ”সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ তাসবীহটি মোট ৩০০ বার পড়া হবে। অর্থাৎ নামাজের স্বাভাবিক যে নিয়ম আছে তা ঠিকই থাকবে। তবে অতিরিক্ত হিসেবে তাসবীহটি ৩০০ বার পড়তে হবে। যেহেতু এই নামাজে অনেকবার এই তাসবীহটি পড়তে হয় তাই এটাকে সালাতুত তাসবীহ বলা হয়।

নামাজ শেষ করে নীরবে নিভৃতে কান্নাকাটি করে আল্লাহকে সব খুলে বলতে হবে। জীবনে যত দোষ হয়েছে সবই আমাদের মাওলা বা মালিক বা অভিভাবক জানেন। অনুনয়-বিনয় করে মাওলাকে বলতে হবে তিনি যেন সকল ত্রুটিবিচ্যুতি মাফ করে দেন। মনে রাখতে হবে, এই নামাজ একা পড়তে হয়। নামাজে মাসনূন কিতাবে আছে, এ নামাজ জামাতে পড়া দুরস্ত নয়। ফাজায়েলে যিকির কিতাবে আছে, এ নামাজ পড়ার উত্তম সময় হলো সূর্য ঢলার পরে পড়া। তারপর দিনে, তারপর রাতে পড়া। যে কোন সূরা দিয়ে এ ৪ রাকাআত নামাজ পড়া যায়। তবে রদ্দুল মুহতার কিতাবে আছে, কেউ কেউ বলেছেন, এ নামাজে সূরা আসর, কাউসার, কাফিরূন ও ইখলাস অথবা সূরা হাদীদ, হাশর, সফ ও তাগাবুন পড়া ভাল।

উল্লেখ্য, যদি কোন এক স্থানে কেহ এ তাসবীহ পড়তে সম্পূর্ণ ভুলে যায় বা ভুলে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে কম পড়ে তাহলে পরবর্তী যে রুকনেই স্মরণ আসুক সেখানে আগের সংখ্যার সাথে এই ভুলে যাওয়া সংখ্যাগুলোও আদায় করে নিতে হবে। আর এই নামাযে কোন কারণে সাজদায়ে সাহু ওয়াজিব হলে সেই সাজদা এবং তার মধ্যকার বৈঠকে এসব তাসবীহ পড়তে হবে না।

আল্লাহ তায়ালা শবে বরাতে আমাদেরকে সুস্থ ও সুন্দর রাখুক এবং আমরা যাতে সালাতুত তাসবীহের নামাজটি নিয়ম মতো পড়ে এর পরিপূর্ণ সাওয়াব হাসিল করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সে তাওফীক দান করুক।

লেখক : ইমাম ও খতীব, বাইতুন নূর জামে মসজিদ, ময়মনসিংহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *