বাড়ছে জ্বালানি তেলের মজুত

বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেশ খানিকটা কমে এসেছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মজুত বাড়াতে চাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগ। ১৮ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় দেশ থেকে আনা হচ্ছে ২১ লাখ টন জ্বালানি তেল। আবার আগামী জুনে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানির প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে।

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ এ বিষয়ে বলেন, দেশে জ্বালানি তেলের মজুত কিছুটা কম থাকলেও তাতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। ছয়টি দেশ থেকে জ্বালানি আমদানির করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। কিছু ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছে। আর কিছু যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে।

তিনি বলেন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে মোট ২১ লাখ টন জ্বালানি তেল আনা হবে। এর মধ্যে ২০ লাখ ৪০ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও ৬০ হাজার টন ডিজেল। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ের জন্য এ তেল কেনা হবে।

বিপিসির চেয়ারম্যান জানান, চলতি বছরে মোট ৫৪ লাখ ৬০ হাজার টন জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিপিসি। এর মধ্যে ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টন পরিশোধিত তেল। বাকিগুলো অপরিশোধিত তেল। সব তেলই আমদানি করা হবে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি)। অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির এরই মধ্যে এটির অনুমোদনও দিয়েছে।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জাতীয় সংসদে জানান, আগামী জুনে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানি শুরু হবে। ডিজেল আনার জন্য ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে পাইলাইন নির্মাণ হয়ে গেছে। পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ডিজেল আমদানির জন্য ভারত অংশে পাঁচ কিলোমিটারসহ প্রায় ১৩১ দশমিক ৫ কিলোমিটার ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন (আইবিএফপিএল) নির্মাণ করা হয়েছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানির প্রি-কমিশনিং কার্যক্রম চলমান। আগামী জুন মাসে ওই পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানির কমিশনিং তথা পরীক্ষামূলকভাবে ডিজেল আমদানি শুরু হবে।

প্রসঙ্গত, দেশে জ্বালানি চাহিদার ৯২ শতাংশই আমদানি করা হচ্ছে। বাকি ৮ শতাংশ আসছে স্থানীয় উৎস থেকে। পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে। কী পরিমাণ জ্বালানি মজুত আছে এখন এমন প্রশ্নের জবাবে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, এটি বলা ঠিক হবে না। তবে মজুত বাড়ানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলে জানান তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনও জ্বালানি তেল মজুত করে রাখার পর্যাপ্ত সক্ষমতা তৈরি করা যায়নি। জ্বালানি তেলের মজুত সক্ষমতা এখন মাত্র ১৩ লাখ টন। এ পরিমাণ জ্বালানি তেল দিয়ে সর্বোচ্চ দেড় মাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। অথচ আপৎকালীন সময়ের জন্য দেশে অন্তত ৯০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত থাকা প্রয়োজন।

তাঁদের মতে, জ্বালানি তেলের যেটুকু মজুত সক্ষমতা আছে, সেটি মূলত বিতরণগত বা বিপণনের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা। কৌশলগত মজুত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তেমন বড় কোনো বিনিয়োগ হয়নি এখানে। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটি ঝুঁকির। কারণ বিশ্ব পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে বা আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন আরও বড় আকারে বাধাগ্রস্ত হলে দেশে তৈরি হতে পারে জ্বালানি সংকট। সক্ষমতা না বাড়ানোর কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও সেটির সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে না বাংলাদেশ।

বিপিসির মজুতকৃত জ্বালানি তেল সংরক্ষণ করা হয় মূলত সংশ্লিষ্ট বিপণনকারী সংস্থার প্রধান, মাঝারি ও ছোট ডিপোগুলোয়। এ সক্ষমতার বড় একটি অংশ রয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। বাকি সক্ষমতা রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটের মোংলা, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ডিপোতে।

কার কত মজুত সক্ষমতা

ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিচালনাধীন দেশের বৃহত্তম জ্বালানি তেল মজুদাগারের সক্ষমতা ৫ লাখ ২ হাজার ২৯০ টন। এর বাইরে জ্বালানি তেল বিপণনকারী সংস্থা পদ্মা ও যমুনা অয়েল এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের আওতাধীন ডিপোগুলোর মোট মজুত সক্ষমতা প্রায় ৮ লাখ টন। এর মধ্যে পদ্মা অয়েলের চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোয় মজুত সক্ষমতা রয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৭৩ টন।

এ ছাড়া বাগেরহাটের মোংলায় ৩৫ হাজার টন ও নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ৩০ হাজার ৯৩৪ টন সক্ষমতার মজুদাগার রয়েছে কোম্পানিটির। যমুনা অয়েলের চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোয় ৮২ হাজার ২৪০ টন এবং মোংলায় ২৯ হাজার ৬৩০ টন মজুত সক্ষমতা রয়েছে।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোয় ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৭৪ টন এবং মোংলায় ২৭ হাজার ৯৭২ টন মজুত সক্ষমতা আছে। এর বাইরে ৩৩ হাজার ৬২৫ টন সক্ষমতার মজুদাগার রয়েছে বিপিসির অধীন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিটেডের (এসএওসিএল)। এ ছাড়া ছোট ছোট আরও কিছু ডিপোয় নানা সক্ষমতার মজুদাগার গড়ে তোলা হয়েছে।

সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ

জ্বালানি চাহিদা ও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে জ্বালানি তেলের মজুত সক্ষমতা এরই মধ্যে বাড়িয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটির জ্বালানি তেলের মজুত সক্ষমতা এখন প্রায় তিন মাসের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশ ভিয়েতনামও জ্বালানি তেলের মজুদাগার গড়ে তুলেছে ৯০ দিনের।

জ্বালানির ৭০ শতাংশ ডিজেল

গত অর্থবছর দেশে মোট জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়েছে প্রায় ৬৯ লাখ টন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই ছিল ডিজেল। বাকি ৩০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল, পেট্রোল, অকটেন, কেরোসিন ও জেট ফুয়েল। খাত বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল লাগে পরিবহন খাতে। এর পরিমাণ প্রায় ৪২ লাখ ৬০ হাজার টন। মোট চাহিদার যা ৬১ দশমিক ৬১ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে আছে কৃষি খাত। গত অর্থবছর এ খাতে জ্বালানি তেল লাগে ১১ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ টন। মোট চাহিদার ১৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ৮ লাখ ৮৩ হাজার টন, শিল্পে ৩ লাখ ৭৯ হাজার টন জ্বালানি খরচ হয়। এগুলো মোট চাহিদার যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *